ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

মাতামুহুরী শাসন করতে চায় জাইকা

অনলাইন ডেস্ক ::
মহেশখালীর মাতারবাড়িতে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, সোনাদিয়ায় দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বাংলাদেশে বড় উন্নয়ন সহযোগী জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। সেই জাইকা নিজেদের অর্থায়নে এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে শাসন (ড্রেজিং) করতে চায় ১৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মাতামুহুরী নদীকে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জাপানি বিনিয়োগে মহেশখালীর মাতারবাড়ি, সোনাদিয়ায় দুটি বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সেই প্রকল্পের প্রতিবেশ–পরিবেশগত সম্ভাব্য ক্ষতির বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নিজ উদ্যোগে এবং নিজস্ব অর্থায়নে এই মাতামুহুরী নদী শাসন করা নিয়ে প্রাথমিক সার্ভের কাজ শুরু করছেন। সেই প্রস্তাব সংস্থার পক্ষ থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) দেওয়ার পর একাধিকবার বৈঠক হয়েছে।

পাউবো ও মাতামুহুরী নদী তীরের বাসিন্দারা জানান, মাতামুহুরী নদীকে পরিকল্পিতভাবে খনন করার জন্য আগ্রহ প্রকাশের অংশ হিসেবে দেড় বছর আগে থেকেই জাপানি কর্মীরা সরাসরি মাতামুহুরী নদীতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছেন। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানতে চেয়েছেন এই নদীর সর্বগ্রাসী রূপটি কেমন। কীভাবে এটি শাসন করা যায়। কথা বলেছেন নদী রক্ষার কাজে নিয়োজিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। জাপানিরা কাজ শুরু করায় এই জনপদের ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন আশায় বুক বাঁধছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাঈফ আহমেদ বলেন, জাইকা নিজেদের উদ্যোগে এবং নিজেদের অর্থায়নে মাতামুহুরী নদীর গতি প্রকৃতি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছে। বেশকটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান দ্বারা নির্দিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ–ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়ও সার্ভে করেছে জাপানি সংস্থাটি।

দুই তিনমাস পরপর সরাসরি জাপানি নাগরিকরা এসেই সরেজমিনে নদীতে গিয়ে এই কাজটি করছেন। তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। কিন্তু কাজটি কীভাবে করবে সেটি ফিজিবিলিটি স্টাডির পরই চূড়ান্ত হবে।

এখন সার্ভে শেষ করে তাদের কাজ সেই স্টাডির আগ মুহূর্তে আছে। সর্বশেষ ডিসেম্বরের বৈঠকে কথা বলে মনে হয়েছে, তারা দুটি বিষয়কে সামনে রেখে এগোচ্ছেন। একটি হচ্ছে, জনবসতি ও সড়কের পাশে থাকা নদীতীর টেকসইভাবে সংরক্ষণ করা। আরেকটি হচ্ছে, খনন ও কিছু স্থানের বাঁক সোজা করা। এর বাইরে ফিজিবিলিটি স্টাডিতে পুরো চিত্র উঠে আসবে।

আমরা মাতামুহুরী নদী শাসনে টেকসই প্রকল্পকেই অগ্রাধিকার দেব, সেই হিসেবে এখনো জাইকার কাজকেই এগিয়ে রাখছি। অবশ্য জাইকার ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট সরকারের অনুমোদনের পরই কাজ শুরু হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এর আগে মাতামুহুরী নদী শাসনের জন্য একটি প্রকল্প নিয়েছিল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। দেশীয় সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) মাধ্যমে মাতামুহুরী, সাঙ্গু ও কর্ণফুলী এই তিন নদী শাসনের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে ফিজিবিলিটি স্টাডিও সম্পন্ন হয়েছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিটি নদীর জন্য পৃথকভাবে স্টাডি রিপোর্টও জমা দেয়।

এরপর সেই প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সাড়ে ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ডিটেইল প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায় পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু মন্ত্রণালয় সেটি ফেরত পাঠায় এবং কিছু ত্রুটি শনাক্ত করে সেগুলো সংশোধনপূর্বক পুনরায় প্রস্তাব পাঠানোর জন্য নির্দেশনা দেয়। এর পর থেকেই সেই প্রস্তারের কোনো গতি নেই।

জানতে চাইলে উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তানজির সাঈফ আহমেদ জানান, তিনি কক্সবাজার জেলায় যোগদানের আগেই ওই ডিপিপি পাঠানো হয়েছিল। সেটি ফেরতও এসেছে। জাইকা কাজ করছে বিধায় পাউবো আপাতত সেদিকে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কারণ সেখানে সরকারের কোনো ব্যয় নেই।

প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুম আসলেই মাতামুহুরী যেন হয়ে পড়ে একটি মরা নদী। আর বর্ষাকালে এই নদীই সর্বগ্রাসী রূপ নেয়। পাহাড়ি এই নদীতে ধেয়ে আসা বন্যার পানিতে প্রতিবছরই কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে, বিলীন হচ্ছে জনপদ, বসতঘর, ফসলি জমি, মাছের ঘের। মূলত তামাক চাষ ঘিরে বন উজাড়, পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে পাহাড়ধস এবং ইটভাটা মালিকদের পাহাড় উজাড় করার কারণেই প্রতিবছরই বন্যায় কক্সবাজার পানি ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।

উপজেলা কৃষি বিভাগ বলছে, প্রতিবছর মাতামুহুরী নদীর মিঠাপানি আটকিয়ে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলা এবং বান্দরবানের লামা ও আলীকদম উপজেলার কয়েক লাখ কৃষক সেচ সুবিধা নিয়ে বোরো ও রবি শস্যের চাষাবাদ করে আসছে।

তদ্মধ্যে চকরিয়া ও পেকুয়ার অন্তত ৭০ হাজার একর জমিতে আমন, বোরো ও রবি শস্যের চাষাবাদ করেন কৃষকরা। নদীতে বালুচর জেগে উঠায় কিছু এলাকায় সেচ সুবিধা নিতে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে জাপানিদের কাজ নিয়ে বড় ধরনের আস্থা রয়েছে দেশের মানুষের মধ্যে। বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে সেই আস্থা ভর করেছে মাতামুহুরী নদীতীরের বাসিন্দাদের মধ্যেও।

মাতামুহুরী নদীতীরের বাসিন্দা কলেজ শিক্ষক মোস্তফা জামান বলেন, জাপানিদেরকে মাতামুহুরী নদীর তথ্য সরাসরি সংগ্রহ করতে দেখে বেশ অবাক হয়েছি। পরে নদী শাসনও তারা করতে চায় শুনে খুবই উচ্ছ্বসিত হয়েছি। এই প্রথম বড় একটি সুযোগ এসেছে জাইকা থেকে। এই সুযোগটা নেওয়া উচিত এবং দ্রুত সুফল পেতে সরকারের সহযোগিতা করা উচিত।

জাইকার প্রস্তাব সরকার গ্রহণ করবে কী–না এমন প্রশ্নে কক্সবাজার–১ (চকরিয়া–পেকুয়া) আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম বলেন, নিঃসন্দেহে জাইকার প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য। এই সুযোগ বারবার আসবে না। তাই সুযোগটি সদ্ব্যবহার করার সময় এসেছে।

কারণ এতে সরকারের কোনো খরচই নেই। উপরন্তু ড্রেজিংয়ের সময় আহরিত বালুর মাধ্যমে সরকার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করতে পারবে। এই প্রস্তাবটি অনুমোদন দিতে জাতীয় সংসদে আমি বিষয়টি উত্থাপন করেছি। আশা করছি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

 

পাঠকের মতামত: